বর্তমানে ডিজিটালের যুগে আমাদের সবারই প্রায় গ্রাফিক্স ডিজাইনের প্রয়োজন পড়ে। স্কুলের বই, নিউজপেপার, পোস্টার লিফলেট, ভিজিটিং কার্ড, বিয়ের কার্ড, টিকেট, ম্যাগাজিন, পোশাকের ডিজাইন, জুতার ডিজাইন, মোবাইল বা কম্পিউটারের ডিজাইন সব কিছুই গ্রাফিক্স ডিজাইনের আওতাধীন। এ সব কিছুই বাস্তবে রুপ পাওয়ার আগে ডিজাইনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো।
উপরোক্ত বস্তুগুলোর ডিজাইন অনেক ভাবেই করা সম্ভব, যেমনঃ ফটোশপের দ্বারা, ফিগমার দ্বারা, ইল্যুস্ট্রেটরের দ্বারা ও আরোও অসংখ্য গ্রাফিক্স ডিজাইন সম্পর্কিত সফটওয়্যার আছে যেগুলোর মাধ্যমে উক্ত ডিজাইনগুলো করা যায়।
আজকে কিন্তু আমরা ভিন্ন একটা গ্রাফিক্স ডিজাইনিং সফটওয়্যার বা এপ্স নিয়ে আলোচনা করব। উপরের উল্লেখিত কোনো গ্রাফিক্স ডিজাইন নিয়ে আলোচনা করব না। আজকে যে সফটওয়্যার বা এপ্স নিয়ে আলোচনা করব সেটা হলো ক্যানভা।
“ক্যানভা কি? বা ক্যানভা ডিজাইন কি? ক্যানভা দিয়ে কিভাবে ডিজাইন করব? ক্যানভা দিয়ে গ্রাফিক্স ডিজাইন করা যায় কি না?” আজকেসকল প্রশ্নের উত্তর দিবো এই আর্টিকেলে। তার সাথে “কিভাবে ক্যানভা একাউন্ট খুলতে হয়, ক্যানভা টুলসের ব্যবহার, ক্যানভার ফ্রি ফিচারস এন্ড প্রো ফিচারস এর ব্যবহার, ক্যানভা দিয়ে কি কি কাজ করা যায়? এবং ক্যানভা দিয়ে ডিজাইন করে ইনকাম করা যায় কি না?” সহ সকল ধরণের খুঁটিনাটি সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করবো।
তাহলে আসুন শুরু করা যাক, প্রথমেই আমরা জানব কিভাবে ক্যানভা একাউন্ট খুলতে হয়। ক্যানভাতে একাউন্ট খোলতে শুধু ইমেইল আইডি ছাড়া আর তেমন কিছুর প্রয়োজন পড়ে না।
কিভাবে ক্যানভা একাউন্ট খোলতে হয়?
ক্যানভাতে একাউন্ট খুলতে হলে প্রথমেই আপনাকে গুগলে গিয়ে canva.com লিখে সার্চ করতে হবে। তারপর গুগল আপনাকে ক্যানভার মেইন পেইজে নিয়ে যাবে, সেখানে দেখতে পারবেন সাইটের উপরের কর্নারে ডানপাশে দুইটা অপশন আছে। একটি হলো Sign Up এবং অপরটি হলো Log in আপনার যেহেতু একাউন্ট খোলা নেই সেহেতু আপনি লগ ইনে ক্লিক না করে সাইন আপে ক্লিক করবেন।
তারপর সেখানে আপনার নাম, জিমেইল আইডি এবং একটা মনে রাখার মতো পাসওয়ার্ড দিয়ে সাইন ইনে ক্লিক করে দিন, ব্যাস…! আপনার একাউন্ট তৈরি। এখন আপনি যত খুশি যেভাবে খুশি ডিজাইন করতে পারেন।
আরো পড়ুনঃ প্রজেক্ট ফ্রন্ট পেইজ ডিজাইন
ক্যানভা ডিজাইন পরিচিতি
ড্যাশবোর্ডে যখন ঢুকবেন সেখানে অনেক গুলো ফিচার পাবেন, যেমনঃ ফেসবুক পোস্ট ডিজাইন, ইন্সটাগ্রাম পোস্ট ডিজাইন, ব্যানার ডিজাইন, লগো ডিজাইন, ভিডিও পোস্ট ডিজাইন সহ আরো অনেক ক্যাটাগরি পেয়ে যাবেন। তাছাড়া আপনি চাইলে নিজের মতো করে কাস্টম সাইজ ডিজাইন করতে পারেন।
আপনি যেকোনো একটি ক্যাটাগরিতে ঢুকলে প্রথমেই কতকগুলো জিনিস স্ক্রীনের সামনে ভেসে উঠবে। সেগুলোর মধ্যে একটা হলো সাদা ক্যানভাস যেখানে আপনি আপনার ডিজাইন করবেন, এর বাম পাশে থাকবে কিছু সাইড প্যানেল। যেগুলো আপনাকে ইতোমধ্যেই অনেক টেমপ্লেট, ফিচার, টেক্সট ও স্টিকার গ্রাফিক্স সাজেস্ট করছে। এখান থেকেই আপনি আপনার প্রয়োজনীয় সকল জিনিস পেয়ে যাবেন।
টেমপ্লেট সেকশনের ব্যবহার
এই সেকশনে হাজার হাজার ফ্রী টেমপ্লেট আছে যা আপনাকে সাজেস্ট করবে সাদা ক্যানভাসটি তে ব্যবহার করার জন্য। আপনি চাইলে সেখান থেকে যেকোনো টেমপ্লেট নিয়ে একটি ডিজাইন করে ফেলতে পারেন, অথবা আপনি চাইলে সেই টেমপ্লেটটা কে পরিবর্তন করতে পারেন বা নিজের মতো আরোও কিছু জিনিস এড করে বা রিমোভ করে সাজাতে পারেন। আরোও কিছু জিনিস এড করতে হলে আপনাকে যেতে হবে এলিমেন্ট সেকশনে।
এলিমেন্ট সেকশনের ব্যবহার
এলিমেন্ট সেকশনেই বেশিরভাগ জিনিস থাকে যেগুলো আমরা ডিজাইনের ক্ষেত্রে ব্যবহার করে থাকি। যেমনঃ লাইনস ও সেইপ, গ্রাফিক্সস, স্টিকারস, ফটোস, মিনি ভিডিওস, অডিওস, চার্টস, ফ্রেমস, টেবলস, গ্রীডস সহ আরোও অনেক এলিমেন্টস আছে যেগুলো প্রত্যেকটা ডিজাইনের ক্ষেত্রেই প্রয়োজন পড়ে।
ধরুন, আপনার একটা সোজা দাগ কাটার দরকার তখন আপনি লাইন্স ও সেইপ থেকে একটা লাইন ড্রাগ করে এনে ড্রপ করে দিতে পারেন। অথবা আপনি একটা ব্র্যান্ডের লগো বা স্টিকার ব্যবহার করতে চাচ্ছেন, সেক্ষেত্রে আপনি গ্রাফিক্সস অপশন থেকে নাম লিখে সার্চ করে ড্রাগ এন্ড ড্রপ করে বসিয়ে দিতে পারেন।
আবার আপনি চাচ্ছেন এমন কিছু গ্রাফিক্স যা নড়াচড়া করবে, তাহলে আপনি চলে যাবেন স্টিকারস অপশনে। ওখানে গিয়ে আপনি যে স্টিকার ব্যবহার করতে চাচ্ছেন তা সার্চ বারে লিখে সার্চ করলেই অসংখ্য ফ্রী এবং প্রো স্টিকারস আসবে, আপনি আপনার পছন্দ মতো কাঙ্ক্ষিত স্টিকারটি বেছে নিবেন।
এরপর বাকি গুলো আপনি দেখেই বুঝে যাবেন যে কোনটা কি কাজ করে। টেবিলস ও চার্টের অপশনগুলো এতোটাও কঠিন না। আপনি আপনার প্রয়োজন মতো চার্ট, টেবিল ও ফ্রেমস নিয়ে নিবেন এবং পছন্দ মতো কালার দিয়ে সেটাকে নিজের মতো করে ডিজাইন করতে পারবেন।
আরো পড়ুনঃ বাংলা টাইফোগ্রাফি কিভাবে করা যায় এবং সাধারণ ধারনা
আপলোডস সেকশনের ব্যবহার
আপলোড সেকশন তখনই ব্যবহৃত হয় যখন কোনো ছবি, স্টিকার, অডিও, ভিডিও, গ্রাফিক্স বা আপনার ছবি সেই ক্যানভা টুলে না থাকে। তখন আপনি গুগল থেকে, ইউটিউব থেকে অথবা আপনার ল্যাপটপ বা কম্পিউটার থেকে কাঙ্ক্ষিত বস্তুটি ডাউনলোড করে সেটা আপলোড ফাইলে আপলোড করার মাধ্যমে ডাউনলোডকৃত বস্তুটিকে ড্রাগ এন্ড ড্রপ করে আপনার ডিজাইনের আওতায় অর্থাৎ সাদা ক্যানভাসে নিয়ে আসতে পারেন।
এক্ষেত্রে এই সেকশনটি অনেকের কাছেই প্রিয়, কারণ তারা তাদের নিজস্ব কিছু সেখানে আপলোডের মাধ্যমে ব্যবহার করতে পারে এবং তাও আবার প্রফেশনালি ভাবে। আপনি এখানে ইচ্ছেমতো আপনার ছবি, গ্রুপ ছবি, ভিডিও, অডিও ইত্যাদি আপলোড করে সেটাকে ইডিট করতে পারেন।
ফটোস এন্ড ভিডিওস অপশনের ব্যবহার
ধরুন, আপনি একটা ডিজাইন করতে গিয়ে ফটো বা ছবির প্রয়োজন পড়ল এবং সেটা একটা ফুলের ছবি। তখন আপনি ফটোস অপশনে গিয়ে সার্চ বারে ফ্লাওয়ারস লিখে সার্চ করলে অসংখ্য ফুলের ছবি পেয়ে যাবেন। সেখান থেকে আপনার পছন্দ মতো ফুলের ছবিটি বেছে নিন।
আবার ধরুন, আপনার একটা ছোট্ট ভিডিওর প্রয়োজন পড়ল আর সেটা হলো বাঘ সম্পর্কিত একটা ভিডিও। তখন আপনি ভিডিওস অপশনে যাবেন এবং সার্চ বারে গিয়ে টাইগারস লিখে সার্চ করলেই বাঘ রিলেটেড অসংখ্য মিনি ভিডিওস চলে আসবে। তখন আপনি আপনার চাহিদা মোতাবেক ভিডিও বাছাই করে ড্রাগ এন্ড ড্রপ করে ডিজাইন করতে পারেন।
টেক্সট এন্ড ব্যাকগ্রাউন্ড এর ব্যবহার
প্রায় প্রত্যকটা ডিজাইনেই টেক্সটের প্রয়োজন পড়ে। কোনো কিছু লিখতে গেলে টেক্সট অপশন থেকে একটি টেক্সট বক্স এনে সেটাতে নিজের লিখা বসিয়ে দিতে পারেন। তারপর সেই লিখাকে বোল্ড, ইটালিক বা আন্ডারলাইন্ড করতে পারেন, টেক্সটের কালার চেইঞ্জ করতে পারেন, টেক্সটের ফন্ট চেইঞ্জ করতে পারেন এবং সেই টেক্সটের উপর নানা রকম ইফেক্টও ব্যবহার করতে পারেন।
সাধারনত যারা ক্রিয়েটিভ কিছু ডিজাইন করতে চায় তারাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ব্যাকগ্রাউন্ড অপশন টি বেছে নেয়। এই অপশনে নানা রকম ব্যাকগ্রাউন্ড কালার আছে, নানা রকম গ্র্যাডিয়েন্ট কালারও আছে এবং বিভিন্ন ধরণের সাইজ ও ইউনিক ডিজাইনের ব্যাকগ্রাউন্ড আছে যেগুলো আপনি আপনার ডিজাইনের ক্ষেত্রে কাজে লাগাতে পারবেন। এতে করে আপনার পরিশ্রম কমে যাবে।
আরো পড়ুনঃ ২০+ সেরা গ্রাফিক্স ডিজাইন শেখার ওয়েবসাইট
মোর এন্ড আদারস অপশনের ব্যবহার
সাইড প্যানেলে সবচেয়ে নিচের অপশনটা হলো মোর অপশন। এখানে আপনি আরোও হিডেন কিছু ক্যাটাগরি পাবেন যেগুলোর দ্বারা আপনার ডিজাইনকে আরোও আকর্ষণীয় করে তুলতে পারবেন। সেই ক্যাটাগরিগুলো কিভাবে ব্যবহার করতে হয় সেটা আপনি ওপেন করার সাথে সাথেই বুঝে যাবেন।
সব সাইড প্যানেলের ব্যবহার সম্পর্কে তো জানা হয়ে গেলো, এবার আসুন আরোও কিছু ছোটখাটো জিনিস সম্পর্কে জেনে নিই। ধরুন, আপনি ডিজাইন করার সময় একটা এলিমেন্ট ভুলে ডিলিট করে দিলেন সেটাকে ফিরিয়ে আনতে আমরা সাধারনত Ctrl + Z ব্যবহার করি, কিন্তু এখানে অন্যভাবেও ফিরিয়ে আনা যায়। সেটা হলো স্ক্রীনের উপরে বাম পাশে হোম ও ফাইল অপশনের পাশে দুইটা বাকানো তীর চিহ্ন আছে যেগুলোর একটাকে বলা হয় Undo এবং অপরটিকে বলা হয় Redo।
তাছাড়া আপনি আপনার লিখা কোনো টেক্সটকে লিস্টেড করতে পারেন, স্প্যেসিং বা এলাইনমেন্ট এর পজিশন ঠিক করতে পারেন। এই সবগুলো অপশন সাদা ক্যানভাসের ঠিক উপরে পেয়ে যাবেন। ওখানেও একটা থ্রী ডটেট (…) মোর অপশন পাবেন সেখানে ক্লিক করলে এর ভিতর আরোও কিছু হিডেন অপশন পাবেন যেগুলোর মধ্যে একটা হলো ট্রান্সপারেন্সি। এটা আপনার যেকোনো ডিজাইনের এলিমেন্টের দৃশ্যমানতা বাড়াতে কমাতে সাহায্য করবে।
হিডেন ক্যাটাগরির আরেকটি হলো পজিশন অপশন। এই অপশনটি যেকোনো ডিজাইনের ক্ষেত্রে অবশ্যই কাজে লাগে। ধরুন, আপনি চাচ্ছেন একটা এলিমেন্ট কে অপর একটা এলিমেন্টের উপরে বা নিচে রাখতে, তখন সেই এলিমেন্ট কে সিলেক্ট করে পজিশন অপশনে গিয়ে সেটাকে ফরোয়ার্ড এর মাধ্যমে উপরে, ব্যাকওয়ার্ড এর মাধ্যমে নিচে এবং মিডল-লেফট-রাইট এর মাধ্যমে উক্ত এলিমেন্টের পজিশন চেইঞ্জ করতে পারবেন।
আরো পড়ুনঃ ফ্রিল্যান্সিং এর জন্য কোন ল্যাপটপ ভালো ?
ডাউনলোড অপশনের ব্যবহার
এবার আসা যাক আমাদের শেষ পর্বে, অর্থাৎ ডাউনলোড অপশনে। আপনি এতোক্ষন যা যা ডিজাইন করলেন তা আপনার মোবাইলের স্টোরেজে বা ল্যাপটপ/কম্পিউটার ডিভাইসে সেভ করার জন্য ডাউনলোড করতে হবে। তার জন্য আপনি উপরে ডান দিকে কর্নারে শেয়ার অপশন দেখতে পাবেন, সেখানে ক্লিক করলে ডাউনলোড বাটন আসবে এবং সেখানে ক্লিক করার সাথে আপনার ডিজাইনের পেইজ শো করবে, ডিজাইনের পেইজটি সিলেক্ট করে সেটা আপনার ইচ্ছামতো PNG, SVG, JPG, Gif, PDF File বা MP4 Video তে কনভার্ট করে ডাউনলোড করতে পারবেন।
এছাড়াও ঐ ডাউনলোড অপশনে আরোও অনেকগুলো অপশন পাবেন। যেমনঃ ডিজাইনের লিংক শেয়ার করতে পারবেন, এখান থেকে ডিরেক্ট সোশ্যাল মিডিয়ায় বা ওয়েবসাইটে পোস্ট করতে পারবেন, ডিজাইনের ইমেজ কপি করতে পারবেন এবং এর QR Code সংগ্রহ সহ আরোও অনেক অপশন পাবেন ডিজাইনের আউটপুটের জন্য।
তো এই ছিলো আজকের আয়োজন। ক্যানভা দিয়ে কিভাবে ডিজাইন করবেন, ক্যানভা টুলসের ব্যবহার, ক্যানভা দিয়ে গ্রাফিক্স ডিজাইন করা যায় কিনা সহ সকল প্রশ্নের উত্তর। কিন্তু আরোও প্রশ্ন কিন্তু রয়েই গিয়েছে, সেই প্রশ্নগুলোর সম্পর্কে এই আর্টিকেলের পার্ট ২ এ আলোচনা করবো, কারণ এই আর্টিকেলটি এমনিতেই অনেক বড় হয়ে গিয়েছে। তো ক্যানভা ডিজাইন কি, এর ব্যবহার ও আয় (পার্ট ২) পড়তে আমাদের সাইটেই চোখ রাখুন এবং ততোক্ষন পর্যন্ত ভালো থাকুন সুস্থ্য থাকুন, আল্লাহ হাফিজ।