প্রায় ১৭ কোটি জনসংখ্যারএই দেশ বাংলাদেশ। বৈশ্বিক ডিজিটালাইজেশনের দিকে বাংলাদেশ দিন দিন এগিয়ে যাচ্ছে। প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মাধ্যমে আমাদের দেশ স্বাবলম্বী হয়ে উঠার পাশাপাশি বিশ্বের দরবারে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবেও নাম লিখিয়েছে।
কিন্তু আমাদের দেশ সবদিক দিয়ে এগিয়ে থাকলেও বেকারত্ব দূরীকরণের দিক দিয়ে পিছিয়ে। কারণ আমাদের দেশের অধিকাংশ যুবক ই বেকার। “আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা”র একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, মহামারির আগে – ‘এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ২৮টি দেশের মধ্যে উচ্চশিক্ষিত বেকারত্বের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়’।
আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে বেকারত্বের হার প্রায় ৩৪ শতাংশ আর স্নাতক পর্যায়ে এই হার প্রায় ৩৭ শতাংশ। এশীয় প্রশান্ত অঞ্চলে মহামারির আগের বছর ২০১৯ সালে বেকার জনগোষ্ঠীর যে সংখ্যা ছিল, ২০২২ সালে এই সংখ্যার প্রায় অর্ধকোটি বেড়েছে। সূত্র-( বিবিসি নিউজ বাংলা )
আরো পড়ুনঃ ফ্রিল্যান্সার হতে চান ?
কিন্তু একটা প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায়, এতো কিছুর পরও আমাদের দেশের রেমিটেন্স এতো বৃদ্ধি পাচ্ছে কিভাবে? এই যে বিলিয়ন বিলিয়ন রেমিটেন্স বাংলাদেশে ঢুকছে এগুলো কাদের মাধ্যমে? এর উত্তর কিন্তু দুইটা – (এক) যারা প্রবাসী তাদের মাধ্যমে এবং (দুই) ফ্রিল্যান্সারদের মাধ্যমে।
এখন আরেকটা প্রশ্ন – ফ্রিল্যান্সিং কি বা ফ্রিল্যান্সার কারা? তার উত্তর হলো – “যারা বেকারত্বের বুঝা বইতে নারাজ বা সমাজকে বেকারমুক্ত করতে এবং দেশের উন্নয়নের লক্ষ্যে অনলাইনের মাধ্যমের নিজের ক্যারিয়ার গড়ে তোলার যে অদম্য লড়াই, সেই লড়াইয়ের একেক জন সৈনিকই হলেন একেক জন ফ্রিল্যান্সার”।
পুরো বিশ্বজুড়ে বৈশ্বিকভাবে বাংলাদেশ থেকে প্রায় সাড়ে ৬ লাখেরও বেশি ফ্রিল্যান্সার কাজ করেন, যাদের মধ্যে প্রায় ৫ লাখের মতো ফ্রিল্যান্সার পার্ট-টাইম এবং ফুল-টাইম বা নিয়মিত কাজ করছেন। যাদের মাধ্যমে প্রতিবছর আমাদের দেশে প্রায় ১০ কোটি ডলারেরও বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আসছে। যা বাংলাদেশী টাকায় ৮৫০ কোটি টাকা, প্রতি ডলারে ৮৫ টাকা ধরে। সূত্র-( যুগান্তর )
জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা আঙ্কটাডের ‘ডিজিটাল ইকোনমাই রিপোর্ট’ এর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, গত এক যুগ ধরে আউটসোর্সিং খাতে বা ফ্রিল্যান্সিং খাতে প্রায় সাড়ে ৬ লাখেরও বেশি মানুষ এই কাজকে নিজের আয়ের মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছেন, যে জায়গায় ২০১১ সালে এই ফ্রিল্যান্সারদের পরিমান ছিল ১০ হাজারের মতো।
তার মানে বুঝতেই পারছেন যে, কিভাবে এবং কতটা দ্রুততার সাথে মাত্র ১০ বছরের মধ্যে এই ফ্রিল্যান্সিং প্ল্যাটফর্মে এতো এতো মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। তার একটাই কারণ আর সেটা হলো মেধার জোড় এবং পরিশ্রমের অভ্যাস।
এখানে জালিয়াতি বা ঘোষের কোনো কারবার নেই, এখানে আপনার প্রতিভাকে দমিয়ে রাখবে এমন কোনো শত্রুও নেই। আপনার যদি মেধা থেকে থাকে তাহলে অবশ্যই আপনাকে তার উপযুক্ত দাম দেওয়া হবে, তার জন্য কোনো মামা-চাচাদের পিছনে দৌড়াতে হবে না।
আরো পড়ুনঃ ফ্রিল্যান্সিং এ কোন ধরণের কাজ করবেন ?
চাকরীর চেয়ে বেশি স্বাধীনতা থাকার কারনে সবাই ফ্রিল্যান্সিং এর দিকেই ঝুঁকছে। তার উপর অফিসে যাওয়ার প্যারা থেকে মুক্তি, নিজের পছন্দ মতো কাজ নেওয়ার স্বাধীনতা এবং যেখানে খুশি সেখান থেকে বা ঘরে বসেই কাজ করার স্বাধীনতা। মূলত এই কারনগুলোর জন্যেই ফ্রিল্যান্সিং সবার কাছে পছন্দের একটি পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তাই পুরো বিশ্বে আউটসোর্সিং এর সেবা প্রদানের দিক দিয়ে এশিয়ার স্থানই প্রথম। সেই সাথে বাংলাদেশও হয়ে উঠেছে ফ্রিল্যান্সিং কর্মসংস্থানের বড় একটি উৎস বা প্ল্যাটফর্ম।
প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারী শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা ‘সালমান এফ রহমান’ এক সাক্ষাতকারে বলেন যে, বাংলাদেশে ফ্রিল্যান্সিং খাতে প্রতি বছরে ১ বিলিয়নেরও বেশি ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। তিনি আরো বলেন যে, ২০২৫ সালের মধ্যে এ খাতে ডলারের পরিমান ২ থেকে ৩ বিলিয়নে উন্নীত হবে বলে আশা করছেন। সূত্র-( সময় নিউজ টিভি )
বিশ্বের টপ রেটেড ফ্রিল্যান্সারদের মধ্যে ৬৪ শতাংশই বাংলাদেশি। বাংলাদেশে পেপ্যাল না থাকায় পারিশ্রমিকের অর্থ তুলতে হতে হচ্ছে নানা ভোগান্তির শিকার। বর্তমানে বিশ্বের ফ্রিল্যান্সিং এর বাজার দাম দেড় ট্রিলিয়ন ডলার। কারণ করোনার আগে গুগল ৪৩ শতাংশ কাজ করাতো, এখন তা বেড়ে ৭৫ শতাংশ হয়ে গেছে। সেই সুবাদে, পুরো বিশ্বের মধ্য থেকে ‘ফ্রিল্যান্সিং এ কর্মী সরবরাহের দিক দিয়ে দ্বিতীয়’ এবং ‘ফ্রিল্যান্সিং করে আয়ের দিক দিয়ে অষ্টম’ স্থান অধিকার করেছে বাংলাদেশ।
আরো পড়ুনঃ ফ্রিল্যান্সিং এর জন্য কোন ল্যাপটপ ভালো ?
আপনার ফ্রিল্যান্সিং এর অর্জিত টাকা আপনার একটি ভার্চুয়াল একাউন্টে জমা থাকে। আপনি চাইলে তা ব্যাংকের মাধ্যমে উঠিয়ে ফেলতে পারেন। যদিও তা সব সময় কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাধ্যবাদকতার কারনে উঠানো সম্ভব হয়ে উঠে না। তবুও চিন্তা নেই, Payoneer ও Wise এর মতো ইন্টারন্যাশনাল পেমেন্ট ব্যবস্থা ব্যবহারের মাধ্যমে আপনার টাকা সহজেই উইথড্র করে ফেলতে পারেন।
আর যদি দেশীয় কোনো প্ল্যাটফর্ম যেমন – কাজ কি, কাজ খুঁজি, স্বাধীন কাজ, বিল্যান্সার এর মতো হয়ে থাকে তাহলে তো টাকা তোলা আরো সহজ। “ব্যাংক, নগদ, বিকাশ, উপায়” এর মতো লেনদেন ব্যবস্থা ব্যবহারের মাধ্যমে সহজেই টাকা উইথড্র করতে পারবেন কোনো রকম ঝামেলা ছাড়াই।
এখনো যদি আপনার প্রশ্ন থেকে থাকে যে, ফ্রিল্যান্সিং করে মাসে কত টাকা আয় করা যায়? বা সব সময় আয়ের পরিমাণ একই থাকবে কিনা? তার উত্তর হলো – আপনি যদি এক্সপার্ট লেভেলের হয়ে থাকেন তাহলে বলবো যে আপনার আয়ের পরিমান প্রত্যেক মাসে এক থাকবে না, কারণ তা দ্বিগুন বা এমনও হতে পারে তিনগুন হারেও বাড়তে পারে।
আর যদি নতুন ফ্রিল্যান্সার হোন তাহলেও প্রত্যেক মাসে আপনার আয়ের পরিমান এক থাকবে না। হয় এই মাসে একটু বেশি হবে বা পরের মাসে একটু কম হবে, সবই নির্ভর করছে আপনার কাজের উপর। তবে পরিশ্রমের সাথে কাজ করা চালিয়ে গেলে আপনার আয়ের পরিমান কমার কোনো চান্স নেই।
আরো পড়ুনঃ ফ্রিল্যান্সিং শিখতে কতদিন লাগে ?
টেন মিনিটস স্কুলের ‘জয়িতা ব্যানার্জী’র কথা মনে আছে? তার জীবনে এমন একটা সময় ছিলো যখন সে তার সেমিস্টারের ফি যোগাড় করতে পারতো না, তারপর যখন সে আউটসোর্সিং ও ফ্রিল্যান্সিং করার সিদ্ধান্ত নেয় তখন থেকেই তার সময় বদলাতে শুরু করে। এখন তার প্রতি মাসিক ইনকাম ১৬০০ ডলারেরও উপরে, যেটা বাংলাদেশী টাকায় ১ লাখ ৩৫ হাজার টাকার মতো প্রায়।
তারপর ফ্রিল্যান্সার নাসিম, সোহাগ, নাঈমের মতো ছেলেদের কথা যদি বলি, তারা শুধু ফ্রিল্যান্সিং এর উপার্জিত টাকা দিয়েই নিজের বাড়ি গাড়ি তৈরি করে ফেলেছে এবং আরাম আয়েসের মধ্যে দিন পার করছে, এরকম হাজারো যুবক যুবতী আছে আমাদের দেশে যাদের ইতিহাস আমাদের অজানা। তাই সর্বোপরিশেষে এই একটা বিষয়ে নিশ্চিত ধারণা করা যেতে পারে যে, ফ্রিল্যান্সিং খাতে বাংলাদেশের আয় আগামী প্রজন্মের জন্য এক নতুন ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার দুয়ার খুলতে যাচ্ছে।