আমাদের দেশের প্রায় ৬ লাখেরও বেশি মানুষ ফ্রিল্যান্সিং পেশার সাথে জড়িত। এই ফ্রিল্যান্সিং করার মাধ্যমেই অনেক মানুষ তাদের অভিশ্বাপময় বেকার জীবন থেকে মুক্ত হয়ে সুন্দর ভাবে তাদের দিন অতিবাহিত করতে পারছে। প্রত্যেক বছর বিদেশ থেকে ফ্রিল্যান্সারদের মাধ্যমে প্রায় ১০ কোটি ডলার রেমিটেন্স বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। যা আমাদের দেশের বেকার সমস্যা দূরীকরণে এবং বিভিন্ন অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
ফ্রিল্যান্সিং এর টাকা যেভাবে ট্রান্সফার করবেন
কিছু কিছু মার্কেটপ্লেস থেকে সরাসরি টাকা তোলা গেলেও সব মার্কেটপ্লেস থেকে সরাসরি টাকা তোলা যায় না। তখন সেই টাকা টা তোলার জন্য বিশেষ কিছু অনলাইনের সার্ভিস ব্যবহার করতে হয় কিংবা বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করতে হয়। যেমন বিভিন্ন ব্যাংক, কার্ড, এজেন্ট ব্যাংক সহ আরো অনেক ধরণের পদ্ধতির দ্বারা টাকা তুলতে হয়।
এমনিতে সাধারণত, আপনার উপার্জিত টাকা আপনার মার্কেটপ্লেসের [upwork.com, freelancer.com, peopleperhour.com, guru.com, 99designs.com, graphicriver.net, themeforest.net] একাউন্টেই ডলার হিসেবে জমা থাকে। যখন লেনদেন কিংবা উত্তোলনের প্রয়োজন পড়ে তখন যেকোনো মানি ট্রান্সফার সার্ভিসের মাধ্যমে আপনি নিজের ব্যাংক একাউন্টে উক্ত টাকা ট্রান্সফার করে নিতে পারেন। এক্ষেত্রে টাকা ট্রান্সফারের সময় বিভিন্ন মার্কেটপ্লেস ভেদে আপনার উত্তলিত টাকার পরিমাণের উপর একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ চার্জ কেটে নেওয়া হবে। আবার নিজের দেশের ব্যাংকে টাকা টান্সফার হওয়ার পর সেখান থেকেও ব্যাংক চার্জ কাটতে পারে।
যেহেতু আপনি ইন্টারন্যাশনাল ভাবে লেনদেন করছেন সেহেতু Swift Code এর প্রয়োজন পড়তে পারে। এক্ষেত্রে আপনাকে খেয়াল রাখতে হবে, আপনি আপনার যে ব্যাংক একাউন্টে টাকা ট্রান্সফার করে এনেছেন সেই ব্যাংকের Swift Code টা যেন আপনার মনে থাকে। ভুলে গেলেও সমস্যা নেই, সেই ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেস করলে কিংবা গুগলে সেই ব্যাংকের নাম লিখে Swift Code এর জন্য সার্চ করলেই পেয়ে যাবেন।
আরো পড়ুনঃ ফ্রিল্যান্সিং এ কোন ধরণের কাজ করবেন?
পেপাল থেকে টাকা উঠানোর টেকনিকঃ
আমাদের দেশে মোটামুটি অনেকগুলো জনপ্রিয় অনলাইন ব্যাংকিং ব্যবস্থা রয়েছে এবংএর মাধ্যমে টাকা লেনদেনের সুযোগ সুবিধাও রয়েছে। সেসব ব্যাংকিং ব্যবস্থার অনুমোদন আমাদের দেশে থেকে থাকলেও পেপাল এর অনুমোদন এখনও পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। তাই অনেক সময় যারা পেপালে লেনদেন করার চেষ্টা করে থাকেন তারা প্রায়ই ভোগান্তির স্বীকার হোন। আজকে আমি আপনাদের শিখাবো কিভাবে পেপালের দ্বারা ব্যাংকের মাধ্যমে ট্রান্সফার করে সেটা বিকাশের মাধ্যমে ক্যাশআউট করা যায়।
তাহলে, প্রথমেই আপনি নিজের বিশ্বস্ত কারোর মাধ্যমে কিংবা কোনো অর্গানাইজেশন এর দ্বারা ইন্টারন্যাশনালি ভাবে পেপালে একটা একাউন্ট খুলবেন, তারপর আপনি আপনার ফ্রিল্যান্সিং এর টাকা পেপালে নিয়ে আসবেন। তারপর গুগলে যাবেন। সেখানে গিয়ে Xoom লিখে সার্চ করবেন, তারপর Xoom থেকে পেপালে লগইন করবেন। লগইন করার পর উইথড্র অপশনে গিয়ে আপনার দেশীয় ব্যাংক সিলেক্ট করবেন। দেশীয় ব্যাংক সিলেক্ট করার পর আপনার টাকার পরিমাণ লিখে সেই ব্যাংকে ট্রান্সফার করে দিন।
তারপর আপনার দেশীয় ব্যাংকের একাউন্ট থেকে bKash সিলেক্ট করে বিকাশে সেন্ড মানি করে দিন। ব্যাস… আপনি এখন চাইলে ব্যাংক কিংবা বিকাশ উভয় জায়গা থেকে টাকা তুলতে পারবেন।
এতো এতো ঝামেলা পার করে টাকা পেতে হয় বলেই অনেকেই পেপালকে এড়িয়ে চলে। আমিও আপনাকে পরামর্শ দিবো পেপালের ঝামেলায় না জড়ানোর জন্য। এর চেয়ে ভালো ভালো কিছু অনলাইন ব্যাংকিং মাধ্যম রয়েছে যেগুলোর সাহায্যে আপনি কোনো রকম ঝামেলা ছাড়াই আপনার মার্কেটপ্লেস থেকে টাকা তুলতে পারবেন। সেই মাধ্যমগুলোর সম্পর্কে নিচে ধাপে ধাপে আলোচনা করবো…
আরো পড়ুনঃ ফ্রিল্যান্সিং শিখতে কতদিন লাগে?
ফ্রিল্যান্সিং এর টাকা তুলতে যা যা প্রয়োজনঃ
সরাসরি ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা নিয়ে আসতে হলে এবং সেই টাকা তুলতে হলে নিম্নোক্ত তথ্যাবলি প্রদান করতে হবে–
- ব্যাংকের নাম ও ঠিকানা, ব্যাংকের একাউন্ট নাম্বার এবং সেই ব্যাংকের Swift Code নাম্বার।
- আপনি যে একাউন্টে বা ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা উত্তোলন করতে চান সেই ব্যাংকটিতে অবশ্যই ইন্টারন্যাশনালি ইন্টারনেট ব্যাংকিং সুবিধা থাকতে হবে। যেমন – Bank Asia, DBBL, Brac Bank, Isami Bank etc. এই ব্যাংক গুলোতে ইন্টারনেট ব্যাংকিং সুবিধা রয়েছে।
- আপনি যে দেশের ফ্রিল্যান্সিং সাইটে কিংবা যে মার্কেটপ্লেসে কাজ করবেন সেই দেশের একটি ব্যাংকের নাম সংগ্রহ করুন যেটা মধ্যস্তকারী হিসেবে কাজ করবে। তারপর আপনি আপনার ব্যাংকের সাথে যোগাযোগ করে জানুন সেই ব্যাংকগুলোর সাথে আপনার ব্যাংক লেনদেন করে কিনা এবং আর কোন কোন ব্যাংকের সাথে লেনদেন করে থাকে।
- অতঃপর আপনাকে সেই দেশের মধ্যস্তকারী ব্যাংকের Router Number সংগ্রহ করতে হবে। যেটা আপনি সেই ব্যাংকের ওয়েবসাইটে কিংবা গুগলে সার্চ করে পেয়ে যাবেন। অনেক দেশে এই নাম্বারকে অনেক নামে ডেকে থাকে, যুক্তরাষ্ট্রে এই নাম্বারকে বলে ABA Routing Number ।
- পরিশেষে ৩ থেকে ৫ দিনের মধ্যে আপনার একাউন্টে আপনার উপার্জিত টাকা পৌঁছে যাবে। প্রতিবারে টাকা উত্তোলনের ক্ষেত্রে আপনার ৪ থেকে ৮ ডলার খরচ হতে পারে।
আরো পড়ুনঃ ফ্রিল্যান্সিং এর জন্য কোন ল্যাপটপ ভালো ?
যেগুলোর মাধ্যমে ফ্রিল্যান্সিং এর টাকা তুলবেনঃ
আমাদের দেশের সেরা কিছু অনলাইন পেমেন্ট সিস্টেম এর নাম এবং কিভাবে ব্যবহার করবেন সে সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে নিচে আলোচনা করা হলোঃ
- Payoneer – সেক্ষেত্রে আপনি পেওনিয়ার ব্যবহার করতে পারেন। বর্তমানে প্রায় সব ফ্রিল্যান্সিং সাইটগুলোতেই মাস্টার কার্ড সার্ভিস টি চালু হয়েছে, আপনি চাইলে বিশ্বের যেকোনো প্রান্ত থেকে ATM এর সাহায্যে আপনার মার্কেটপ্লেস থেকে জমানো টাকা তুলতে পারবেন। এই মাস্টার কার্ড কিংবা ATM কার্ডটি পেতে হলে আপনাকে Payoneer এর ওয়েবসাইটে গিয়ে একটা একাউন্ট খুলতে হবে এবং কিছু নির্দিষ্ট পরিমানের চার্জ পরিশোধ করতে হবে।
অতঃপর ১৫-২০ দিনের মধ্যে আপনার ঠিকানায় মাস্টারকার্ড টি পৌঁছে যাবে। কার্ডটি হাতে পাওয়ার পর এর মধ্যে ৪ সংখ্যার একটি গোপন পিন কোড দিবেন, পরবর্তীতে যেকোনো ATM বুথ থেকে এই কোডের মাধ্যমে টাকা উঠাতে পারবেন। এই কার্ড দিয়ে আপনি অনলাইনে শপিং সহ যেকোনো ধরণের কেনাকাটা করতে পারবেন এবং বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে বসে রিলেটিভকে টাকা পাঠাতে পারবেন কিংবা তার কাছ থেকে টাকা আপনার একাউন্টে আনতে পারবেন।
আমাদের দেশের প্রায় সব ব্যাংকেই এখন ATM কার্ড সাপোর্ট করে, তাই আপনি চাইলে যেকোনো ATM থেকে টাকা তুলতে পারবেন। প্রতিবার টাকা উত্তোলনের সময় আপনার একাউন্ট থেকে চার্জ হিসেবে ২ থেকে ৩ ডলার কেটে নেওয়া হবে। আপনি যদি (বাৎসরিক)এককালীন ভাবে চার্জ পরিশোধ করতে চান তাহলে খরচ পড়বে ২৯ ডলারের মতো আর মাসিকের ক্ষেত্রে ৩ ডলারের মতো।
- Skrill – আপনার টাকা মার্কেটপ্লেসে জমা হওয়ার পর সেই টাকা কে স্ক্রিলে ট্রান্সফার করতে পারেন, এক্ষেত্রেও মার্কেটপ্লেস ভেদে আপনার কাছ থেকে ট্রান্সফার ফি কেটে নিতে পারে। এর পর স্ক্রিল থেকে আপনার দেশীয় ব্যাংক একাউন্টে ট্রান্সফার করে দিবেন, এই ধাপেও ব্যাংক কে ট্রান্সফার ফি দিতে হতে পারে। এখানেও আপনার দেশীয় ব্যাংক এর Swift Code প্রয়োজন পড়বে। নাহলে টাকা স্ক্রিল থেকে আপনার ব্যাংক একাউন্টে ট্রান্সফার হবে না। এই পুরো প্রক্রিয়াটি প্রথম লেনদেন বা ট্রাঞ্জেকশানের ক্ষেত্রে প্রায় ৩০ দিনের মতো লাগে, পরবর্তীতে সাধারণত প্রায় ৭ দিনের মধ্যেই হয়ে যায়। এক্ষেত্রে টাকা উইথড্র করতে খরচ পড়ে প্রায় ৩.৯৫ ডলার।
- Xoom – যুমের সাহায্যেও টাকা উত্তোলন করা যায়, তার জন্য আপনাকে গুগলে গিয়ে Xoom লিখে সার্চ করতে হবে, তারপর সেখানে একটা একাউন্ট খুলে কোন মার্কেটপ্লেস থেকে টাকা ট্রান্সফার করে আপনার Xoom একাউন্টে আনতে চান সেটা সিলেক্ট করুন। তারপর সেখান থেকে আপনার ব্যাংক একাউন্টে, নগদে, উপায়ে কিংবা বিকাশে ট্রান্সফার করে উত্তোলন করতে পারেন।
- Tap Tap Send – ট্যাপ ট্যাপের ক্ষেত্রে তো টাকা উত্তোলন করা আরোও সোজা। তার জন্য আপনাকে প্রথমে গুগলে যেতে হবে, গুগলে গিয়ে Tap Tap Send লিখে সার্চ করবেন এবং তাদের ওয়েবসাইটে গিয়ে একটা একাউন্ট খুলবেন। তারপর সেখান থেকে কোন দেশে টাকা পাঠাবেন সেটা সিলেক্ট করে, তার ব্যাংক একাউন্ট নাম্বার লিখে, সেই সাথে আরোও রিকোয়ার্ড* যেসব তথ্য চায় সেগুলোদিয়ে এবংটাকার পরিমান লিখে সেন্ড করে দিলেই সেটা ডিরেক্ট তার ব্যাংক একাউন্টে গিয়ে পৌঁছাবে। মজার ব্যাপার হলো এই টাকা সেন্ড করতে কিংবা এই টাকা উত্তোলন করতে কোনো রকম চার্জ দিতে হয় না। তাই আপনি যত ডলারই উত্তোলন করতে চান না কেন Tap Tap Send হবে সবচেয়ে ভালো মাধ্যম।
- bKash/নগদ/Upay/সরাসরি ব্যাংক – যখন আপনি একজন কিংবা একাধিক ক্লায়েন্টের সাথে বার বার কাজ করবেন অর্থাৎ তারা যখন আপনার রেগুলার ক্লায়েন্ট হয়ে যাবে তখন তাদের সাথে ফাইভার কিংবা আপওয়ার্কের মতো মার্কেটপ্লেস থেকে প্রজেক্ট না নিয়ে সরাসরি ই-মেইলের মাধ্যমে প্রজেক্ট নিতে পারেন। ক্লায়েন্ট যদি বিদেশী হয় তাহলে সরাসরি ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন করবেন, এক্ষেত্রে উপরের মাধ্যমগুলোর প্রয়োজন পড়তে পারে আবার নাও পড়তে পারে। আর যদি বাংলাদেশী ক্লায়েন্ট হয় তাহলে বিকাশ/নগদ/উপায় কিংবা সরাসরি ব্যাংকের মাধ্যমেও লেনদেন করতে পারেন।
আশা করছি এই মাধ্যমগুলো দিয়ে লেনদেন করলে টাকা উত্তোলনের ক্ষেত্রে কোনোরকম সমস্যার সম্মুখীন হবেন না। এরপরও যদি কোনো সমস্যার সম্মুখীন হোন তাহলে আমাদেরকে নিচে কমেন্ট বক্সে জানাতে পারেন। আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করবো আপনার সমস্যাগুলোকে সমাধান করতে।