ফ্রিল্যান্সিং কি?
ফ্রিল্যান্সার শব্দটি সর্বপ্রথম ১৮১৯ সালে Walter Scott নামক একজন লেখকের বইতে ছাপা হয়। এরপর থেকেই শুরু হয় ফ্রিল্যান্সিং নিয়ে নানারকম জল্পনা কল্পনা। ফ্রিল্যান্সিং কাকে বলে? ফ্রিল্যান্সিং কেন করবো? ফ্রিল্যান্সিং এ দক্ষ হতে হলে কি কি প্রয়োজন? সহ নানা রকমের সব প্রশ্নের উদ্ভব হতে শুরু করে।
ফ্রি (Free) শব্দের অর্থ হলো ‘মুক্ত’ এবং ল্যান্স (lance) শব্দের অর্থ হলো ‘যন্ত্রপাতি’ যেগুলোর দ্বারা কোনো কাজ করা হয়। অর্থাৎ Freelancing এর পুরো অর্থ দাড়ায় “এমন কোনো কাজ করা যেটা মুক্ত বা স্বাধীন”।
ফ্রিল্যান্সিং মূলত এমন একটি পেশা যেখানে আপনি ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের কাজ করে অর্থ উপার্জন করতে পারবেন। হোক সেটা দেশের ভিতরের কিংবা দেশের বাইরের।
এটি সাধারন চাকরির মতোই, কিন্তু ভিন্নতা হলো এখানে আপনি আপনার ইচ্ছেমতো কাজ করতে পারবেন। দেখা গেলো আপনার এখন কাজ করতে ইচ্ছা করছে না; আপনি করবেন না। যখন ইচ্ছা করবে তখন আবার চাইলেই করতে পারবেন। এখানে কাজ করার ক্ষেত্রে জায়গাভেদে কোনো ধরা বাঁধা নিয়ম নেই। আপনি চাইলেই এই কাজ অফিসে বসে করতে পারেন আবার ঘরে বসেও করতে পারেন।
আরো পড়ুনঃ ফ্রিল্যান্সিং এবং ক্রিয়েটিভিটি
আউটসোর্সিং কি?
ইংরেজী শব্দ Outside Resourcing এর সংক্ষিপ্ত রুপই হলো “আউটসোর্সিং”। ১৯৮৯ সালের দিকে সর্বপ্রথম আউটসোর্সিং শব্দটির উদ্ভব হয় এবং এটাকে প্রথম একটি বিজনেস স্ট্র্যাটেজি হিসেবে দেখা হয়। পরে ১৯৯০ এর দশকে এই বিষয়টিকে ব্যবসায়িক অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এরপর থেকেই আউটসোর্সিং সম্পর্কে মানুষের নানা রকম আগ্রহ সৃষ্টি হতে থাকে।
আউট(Out) শব্দের অর্থ ‘বাইরে’ এবং সোর্স (Source) শব্দের অর্থ ‘উৎস’। অর্থাৎ Outsourcing এর পুরো অর্থ দাড়ায় “বাহিরের কোনো উৎস হতে কাজ করিয়ে আনা”।
আউটসোর্সিং এর অর্থ হলো কোনো প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির কাজ বাহিরের কোনো সোর্স বা উৎস হতে করিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া। যেমন ধরুন – “আপনার কোম্পানির একটা কাজ করানোর জন্য কোম্পানির ভিতরে কোনো যোগ্য লোক খুঁজে পাচ্ছেন না। এমতাবস্তায় আপনি বাইরের কোনো ফ্রিল্যান্সারকে এই কাজ টা করে দেওয়ার বিনিময়ে কিছু অর্থ অফার করলেন এবং সে উক্ত কাজটি করে দিতে রাজি হলো। ব্যাস, এটাকেই বলে আউটসোর্সিং”।
অর্থাৎ, আপনার কোনো কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের কাজ যখন আপনি নির্দিষ্ট পারিশ্রমিক প্রদানের বিনিময়ে কোম্পানির বাইরের কোনো সোর্স হতে যেকোনো ধরণের অনলাইন বা অফলাইন ভিত্তিক কাজ করিয়ে নেন তখনই আপনি আউটসোর্সিং এর আওতায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে যান।
সহজ কথায়, ‘একজন ফ্রিল্যান্সার যে কাজে পারদর্শী তাকে দিয়ে সেই কাজ করিয়ে নেওয়ার বিনিমিয়ে আপনি যে অর্থ প্রদান করেন, সেটাকেই মূলত আউটসোর্সিং বলা হয়ে থাকে।
আরো পড়ুনঃ ফ্রিল্যান্সিং শিখতে কতদিন লাগে?
ফ্রিল্যান্সিং ও আউটসোর্সিং এর মধ্যে পার্থক্য
আশা করছি আপনারা ফ্রিল্যান্সিং কি ও আউটসোর্সিং কি সেই সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পেয়ে গেছেন এবং এই বিষয়গুলো নিয়ে মনে কোনোরকম প্রশ্নও নেই। এবার আসা যাক ফ্রিল্যান্সিং ও আউটসোর্সিং এর মধ্যে কি কি পার্থক্য রয়েছে সেগুলোর বিস্তারিত আলোচনায় –
- উৎপত্তিঃ ফ্রিল্যান্সিং এর সূচনা শুরু হয়েছিল ১৯৯৮ সালের দিকে এবং এর যাত্রা GURU নামক ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটপ্লেস থেকে শুরু হয় যা তৎকালীন সময়ে SOFTmoonlighter.com নামে পরিচিত ছিলো। অন্যদিকে, ১৯৮৯ সালের দিকে সর্বপ্রথম আউটসোর্সিং শব্দটির উদ্ভব হয় এবং এটাকে প্রথম একটি বিজনেস স্ট্র্যাটেজি হিসেবে দেখা হয়।
- সংজ্ঞাঃ অনলাইনে ইন্টারনেটের মাধ্যমে ইচ্ছেমতো কাজ নির্বাচন করে সেই কাজ সম্পন্ন করে দেওয়ার বিনিময়ে যে অর্থ উপার্জন করা হয় তাকে ফ্রিল্যান্সিং বলে। অন্যদিকে, একজন ফ্রিল্যান্সারকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেওয়ার বিনিমিয়ে তাকে অর্থ প্রদান করতে হয়, এই অর্থের বিনিময়ে ফ্রিল্যান্সারদের থেকে কাজ হাসিল করার পদ্ধতিকেই আউটসোর্সিং বলে।
- সম্পর্কঃ একজন ফ্রিল্যান্সার কাজ করার পর বাইরের সোর্স থেকে তার পেমেন্ট পেয়ে থাকেন। অন্যদিকে, একজন আউটসোর্স ঠিকাদার ফ্রিল্যান্সারকে কাজ এবং কাজের শেষে পেমেন্ট উভয়ই দিয়ে থাকেন।
- কার্যক্রমঃ কাজ করার ক্ষেত্রে ফ্রিল্যান্সারদের কোনো ধরা বাঁধা নিয়ম মানতে হয় না। তারা যখন খুশি কাজ করতে পারেন বা শুরু করতে পারেন, মোটকথা হলো তাদের ডেডলাইনের আগে কাজ জমা দিতে পারলেই হলো। তিনি যদি সময়মত কাজ জমা দিতে পারেন তাহলেই পেমেন্ট পাবেন নতুবা তাকে পেমেন্ট করা হবেনা।
অন্যদিকে, একজন আউটসোর্স ঠিকাদার নিজের প্রতিষ্ঠানের কাজ করানোর জন্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে ফ্রিল্যান্সারদের হায়ার করে থাকেন কিন্তু অস্থায়ীভাবে। অনেক সময় আউটসোর্স ঠিকাদাররা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের জন্যও ফ্রিল্যান্সার যোগান দিয়ে থাকেন, এতে আউটসোর্স ঠিকাদার একটি প্রতিষ্ঠান এবং একজন ফ্রিল্যান্সারের মধ্যে মধ্যস্তকারী হিসেবে ভূমিকা পালন করেন।
- পেমেন্টঃ একজন ফ্রিল্যান্সার একটি কাজ করার পূর্বে ঠিক যতটাকা পেমেন্ট হিসেবে পাবে বলে চুক্তিবদ্ধ হবে, কাজের শেষে ঠিক ততো টাকাই চুক্তিনুযায়ী পাবে। কিন্তু সে কোনো রকম মাসিক বেতন পাবে না। অন্যদিকে, ঠিক একইভাবে একজন আউটসোর্স ঠিকাদার ফ্রিল্যান্সারদের সাথে হওয়া চুক্তিনুযায়ী কাজের শেষে তাদের পেমেন্ট দিয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে আউটসোর্স ঠিকাদাররাও ফ্রিল্যান্সারদের কোনো রকম বেতনভুক্ত কর্মচারী হিসেবে রাখেন না।
- সুবিধাঃ ফ্রিল্যান্সিং এর ক্ষেত্রে একজন ফ্রিল্যান্সারই সর্বেসর্বা। সে নিজেই নিজের শিডিউলের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। তাকে কাজ করার জন্য কেউ চাপ প্রয়োগ করতে পারে না, সে যখন খুশি কাজ করতে পারে আবার চাইলে ছেড়েও দিতে পারে। একজন ফ্রিল্যান্সারকে ৯ টা থেকে ৫ টা পর্যন্ত অফিস টাইম দিতে হয় না, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যেকোনো সময় কাজ করলেই হয়। বাসায় বসেও কাজ করা যায় বিধায় অফিসে গিয়ে কাজ করার কোনো প্যারা থাকেনা।
অন্যদিকে, একজন আউটসোর্স ঠিকাদার ফ্রিল্যান্সারদের দ্বারা কম অর্থ ব্যয় ও কম পরিশ্রম করার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় কাজ হাসিল করে নিতে পারে। নিয়োগকৃত ফ্রিল্যান্সারদের জন্য সেরকমভাবে কোনো দায়িত্ব নিতে হয় না এবং তাদেরকে কাজ করার জন্য কোনো অফিস স্পেসও দিতে হয় না।
- অসুবিধাঃ ফ্রিল্যান্সিং এর ক্ষেত্রে একটা না একটা ঝুঁকি থেকেই যায়। এমন কোনো গ্যারান্টি নেই যে আপনাকে কোনো কাজ দেওয়া হবেই বা আপনাকে পেমেন্ট করা হবেই। যেহেতু আপনি স্বশরীরে গিয়ে কোনো চুক্তি করছেন না সেহেতু পেমেন্ট না পাওয়ার বা ধোঁকা খাওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়। আর ফ্রিল্যান্সিং এর ক্ষেত্রে প্রত্যেক মাসের আয় একরকম থাকে না, আপনি যতটুকু কাজ করবেন ঠিক ততোটুকু টাকাই উপার্জন করতে পারবেন। তাছাড়া সব সময় আপনার কাঙ্ক্ষিত কাজ টি খুঁজে নাও পেতে পারেন।
অন্যদিকে, আউটসোর্স ঠিকাদাররা সঠিক তথ্য ফ্রিল্যান্সারদের সময়মতো না দিতে পারলে কাজ হাসিল করতে পারবে কিনা তারও কোনো গ্যারান্টি থাকে না, কারণ একজন ফ্রিল্যান্সার যেকোনো সময় কাজটি করতে পারবে না বলে বাতিল করে দিতে পারে। অনেক সময় ফ্রিল্যান্সাররা ঢিলেমি করার কারনে কাজ শেষ করতে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি সময় নষ্ট করে ফেলে। তাছাড়া সব সময়ই যে আউটসোর্সিং করে ভালো এবং মানসম্মত কাজ পাওয়া যাবে তারও কোনো গ্যারান্টি নেই।
- উদাহরণঃ ধরুন, মিঃ আতিক একজন গ্রাফিক্স ডিজাইনার, যিনি মূলত বিভিন্ন ডিজাইনে পারদর্শী। এখন তাকে একটি প্রতিষ্ঠান থেকে তাদের জন্য একটি ওয়েব সাইট ডিজাইন তৈরি করে দেয়ার প্রস্তাব করা হলো, যার বিনিময়ে তিনি পাবেন ১০০ ডলার। এখন তিনি চাইলে কাজটি করতে পারেন এবং তার বিনিময়ে উক্ত অর্থ পেতে পারেন, আবার নাও করতে পারেন। মূলত এটিই হলো ফ্রিল্যান্সিং।
আবার একইভাবে ধরুন, একটি প্রতিষ্ঠানের নতুন ওয়েবসাইট ডিজাইন বানানোর প্রয়োজন হয়েছে। এ ক্ষেত্রে শুধুমাত্র ওয়েব ডিজাইনের জন্য আলাদা একজন কর্মীকে চাকরি দেওয়া তাদের জন্য ব্যয়বহুল হয়ে যাবে। তাই তারা বাইরে থেকে নির্দিষ্ট পারিশ্রমিকের বিনিময়ে ওয়েব ডিজাইনে দক্ষ এমন কোনো ফ্রিল্যান্সারের মাধ্যমে ওয়েব সাইট ডিজাইনটি তৈরি করিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এক্ষেত্রে উক্ত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বাইরে থেকে ফ্রিল্যান্সার নিয়োগের বিষয়টিই হলো আউটসোর্সিং।
শেষ কথা ফ্রিল্যান্সিং এবং আউটসোর্সিং এর মধ্যে পার্থক্য থাকলেও এদের মধ্যে কিন্তু নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে, বলা যায় একই মুদ্রার এপিট ওপিট। কারন ফ্রিল্যান্সারদের ছাড়া আউটসোর্সিং হয় না। আবার আউটসোর্সিং সিস্টেম আছে বলেই ফ্রিল্যান্সাররা এখনো বাজারে টিকে আছে। আশা করছি আমি আপনাদেরকে ফ্রিল্যান্সিং কি, আউটসোর্সিং কি, তাদের মধ্যে পার্থক্য এবং তাদের মধ্যেকার সম্পর্ক সঠিকভাবে তুলে ধরতে পেরেছি। আমার এই আর্টিকেলটি যদি আপনাদের কোনো উপকারে এসে থাকে কিংবা ভালো লেগে থাকে তাহলে অবশ্যই শেয়ার করে অন্যদেরও জানতে সাহায্য করুন।