ইন্টারনেট যে আমাদের জীবন যাপনে এক অভাবনীয় পরিবর্তন এনে দিয়েছে তার প্রমাণ এখন আমরা প্রতিটি পদে পদে পাচ্ছি। বর্তমানে আমরা প্রায় প্রত্যেকেই কোনো না কোনো ভাবে ইন্টেরনেটের সাথে সম্পৃক্ত আছি। কেউ খবর পড়ি, কেউ খেলা দেখি, কেউ বিনোদন জন্য ফেসবুক স্ক্রোল করি, কেউ চ্যাটিং করে সময় পার করি, তো কেউ কিছুক্ষণ পর পর পোস্ট করি।
ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্য কোনো শক্ত কারণ লাগে না। এই জিনিসটাকেই মাথায় রেখে অনেকগুলো প্ল্যাটফর্ম ইন্টারনেটের সাহায্যে ইনকাম করার রাস্তাও আবিষ্কার করে দিয়েছে। যেমন – Facebook, Instagram, Twitter, Pinterest and LinkedIn সহ আরো অনেকগুলো প্ল্যাটফর্ম তাদের সাইটকে পুরো বিশ্বের কাছে ইনকামের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছে। আপনি চাইলেই এখন ঐসব প্ল্যাটফর্মগুলোতে নিজের একটা ব্যবসা শুরু করে দিতে পারেন, যেটাকে আমরা সহজ ভাষায় অনলাইন বিজনেস বলি। আবার আপনি চাইলে সেখানে চাকুরীও করতে পারেন।
তবে আজকে আমি ফেসবুকে অনলাইন ব্যবসা কিভাবে শুরু করবেন তার সম্পূর্ণ গাইডলাইন নিয়েই আলোচনা করবো। কিন্তু তার জন্য যে যে পদক্ষেপগুলো গ্রহন করবেন তা নিম্নে পয়েন্ট আকারে দেওয়া হলোঃ
- মানসিক প্রস্তুতিঃ আপনি যখনই কোনো বড় কাজ করতে যাবেন তার মধ্যে বাঁধা বিপত্তি আসবেই। তার জন্য মানসিক প্রস্তুতিটাও সেই ভাবেই নেওয়া দরকার, যাতে সেগুলোকে মোকাবিলা করতে পারেন।
- নাম নির্বাচনঃ ফেসবুকে অনলাইন ব্যবসা দেওয়ার ক্ষেত্রে আপনাকে এরকম একটা নাম সিলেক্ট করতে হবে যাতে সেটা খুব ইউনিক হয় এবং অতি সহজেই সবার মনে থাকে। আর বিশেষ করে নামের সাথে যেন আপনার প্রোডাক্ট বা সেবার সামঞ্জস্য থাকে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
- আইনী কার্যক্রমঃ আপনি যখন অনলাইনে বিজনেস করতে যাবেন তার জন্য অবশ্যই আপনার ব্যবসাকে বৈধ প্রমাণ করতে হবে এবং সেই সাথে সে ব্যবসায়ের জন্য সার্টিফিকেট এবং ট্রেড লাইসেন্স গ্রহন করতে হবে। অন্যথায়, আপনি আপনার গ্রাহকের আস্থা অর্জন করতে পারবেন না এবং ভবিষ্যতে আপনার ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও থেকে যাবে।
- পন্য বা সেবা নির্বাচনঃ অনলাইন ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে অনেক চিন্তা ভাবনা করে এবং বাজার গবেষণা করার পর পন্য বা সেবা নির্বাচন করা উচিত। যে পন্য বা সেবার চাহিদা বাজারে সবচেয়ে বেশি এবং তাতে ঝুঁকির তুলনায় লাভের পরিমাণ বেশি থাকে সেই পন্য বা সেবাকেই নির্বাচন করতে হবে।
- অনলাইন মার্কেটিংঃ এখানে অনলাইন মার্কেটিং বলতে গুগল র্যাংককে বুঝানো হয়েছে। আবার সোশ্যাল মিডিয়ায় আপনার বিজনেস সম্পর্কে বিভিন্ন অ্যাড দেওয়া এবং পোস্ট করার কাজগুলোকেও অনলাইন মার্কেটিং বলে। ফেসবুক সহ বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোতে আপনার বিজনেস সম্পর্কে মার্কেটিং করা চালিয়ে যেতে হবে। আপনি যত বেশি মার্কেটিং করবেন, ততো বেশি গ্রাহক বাড়বে আপনার।
- পন্য বা সেবার দাম/মূল্যঃ পন্য নির্বাচন এবং অনলাইন মার্কেটিং এর পর সেই প্রোডাক্টের উপর ভিত্তি করে তার বাজার মূল্য গবেষণা করতে হবে। সেই সাথে আপনার পন্যের গুনগতমান ঠিক রেখে যতো কম খরচ করে পন্য বা সেবা উৎপাদন করতে পারবেন, ততো কম দামে আপনি উক্ত পন্য বা সেবা বিক্রি করতে পারেন। এতে গ্রাহকরা আপনার পন্যের দিকে দৃষ্টি দিবে এবং প্রতিযোগিতার তালও ঠিক থাকবে।
- ডেলিভারিঃ সঠিক সময়ের ভিতরে কাস্টমারের কাছে প্রোডাক্ট বা সেবা পৌঁছে দিতে পারলে খুব সহজেই তাদের মন জয় করা যায়। তাই তাদেরকে যতো দ্রুত প্রোডাক্ট বা সেবা ডেলিভারী দিতে পারবেন, ততো আপনার ব্যবসায়ের জন্য ভালো। অর্ডার ট্র্যাকিং এর মতো ফ্যাসিলিটি দিতে পারলে আরোও ভালো হয়, এতে কাস্টমাররা তাদের প্রোডাক্টটা কোথায় অবস্থান করছে সেটা জানতে পারবে। ফলে আপনাকে প্রোডাক্টের লোকেশন সম্পর্কে বেশি প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবেনা।
- পেমেন্ট সিস্টেমঃ আপনার পন্য বা সেবার মূল্য কিভাবে কাস্টমাররা পরিশোধ করবে সে পদ্ধতিও আপনাকেই বের করে দিতে হবে। বর্তমানে অনেক অনলাইন পেমেন্ট সিস্টেম চালু হয়েছে, যেমন – বিকাশ, নগদ, রকেট, উপায়। আপনি এই অনলাইন পেমেন্ট সিস্টেমের অপশনগুলো আপনার ফেসবুক পেইজে বা ওয়েবসাইটে দিয়ে রাখতে পারেন। আবার চাইলে একদম ক্যাশ অন ডেলিভারি সিস্টেমও চালু রাখতে পারেন। এতে কাস্টমাররা আপনার পন্য বা সেবার উপর থেকে আস্থা হারাবে না।
- ডিসকাউন্ট অফার রাখাঃ গ্রাহকদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ছোট ছোট অফার বা ডিসকাউন্টের ব্যবস্থা রাখতে পারেন। যেমন – ৩০% ধামাকা অফার, ফ্রি ডেলিভারী, একটা কিনলে আরেকটা ফ্রি, লটারীর মাধ্যমে আকর্ষণীয় পুরষ্কার জেতার সুযোগ সহ ইত্যাদি ইত্যাদি। এতে গ্রাহকদের প্রশংসা এবং মনোযোগ দুটোই পাওয়ার সুযোগ থাকে।
- রিভিউ সিস্টেমঃ আপনাদের পন্য বা সেবা বিক্রির পর উক্ত ক্রেতাদের থেকে ফাইভ স্টার বা পজেটিভ রিভিউ নেওয়ার চেষ্টা করুন। তার জন্য তাদের অনুরোধ করতে পারেন, চকলেট দিতে পারেন কিংবা কিছু টাকা ডিসকাউন্টের আশ্বাসও দিতে পারেন।
- নিজস্ব টিম তৈরি করাঃ একটা ব্যবসা শুরুর প্রথম দিকে কাস্টমার কিছুটা কমই থাকে, যার ফলে আপনি একাই তাদের সব কিছু মেইন্টেইন করতে পারেন। কিন্তু ধীরে ধীরে যখন ব্যবসা বড় হতে থাকবে, তখন কিন্তু আপনার একার পক্ষে সব কাস্টমারদের সামলোনো সম্ভব হবেনা। তখনকার কথা বিবেচনা করে আপনার একটা নিজস্ব টীম গঠন করতে হবে, যাতে আপনার এগিয়ে যাওয়ার গতি কখনো কমে না যায়। কারণ আপনি একা যত দূর এগোতে পারবেন, একটা টীমের দ্বারা তার চেয়ে তিনগুন বেশি এগোতে পারবেন।
তো এই ছিলো ফেসবুকে অনলাইন ব্যবসা কিভাবে শুরু করবেন তার সম্পূর্ণ গাইডলাইন। এখন আপনাদের জানাবো ফেসবুকে অনলাইন ব্যবসা শুরু করার সেরা ৫টা উপায় সম্পর্কে। যেগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো –
(১) ফেসবুক মার্কেটপ্লেসঃ ফেসবুক মার্কেটপ্লেস হলো এমন একটা অফিসিয়াল সার্ভিস সেন্টার, যেখানে আপনি আপনার প্রোডাক্টগুলো বিক্রির জন্য সাজিয়ে রাখতে পারবেন। তার জন্য আপনাকে প্রথমে ফেসবুকে একাউন্ট খুলতে হবে, তারপর যে প্রোডাক্টগুলো অনলাইনে বা ফেসবুকে বিক্রির জন্য প্রদর্শন করতে চান সেগুলোকে ছবি, মূল্য এবং যাবতীয় ডিটেইলস সহ মার্কেটপ্লেসে পাবলিশ করতে হবে।
অতঃপর মার্কেটপ্লেসে আপনার নিজস্ব প্রোডাক্ট লিস্ট থাকার ফলে সবাইকে আপনার প্রোডাক্ট দেখাতে পারবেন। এরপর থেকে নিত্য নতুন প্রোডাক্টের ছবি নিজের আইডিতে বা বিভিন্ন গ্রুপ, পেইজে শেয়ার দিতে থাকবেন। কম দামে ভালো জিনিস পেলে মানুষ আপনার প্রোডাক্টের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়বে।
(২) ফেসবুক পেইজঃ আপনার প্রোডাক্ট যদি খুবই চাহিদা সম্পন্ন বা ইউনিক লেভেলের প্রোডাক্ট হয়ে থাকে তাহলে আপনি এই প্রোডাক্টের উপর ভিত্তি করে একটা ফেসবুক পেইজ তৈরি করে ফেলতে পারেন। এতে আপনি খুব সহজেই আপনার ক্রেতাদের পেয়ে যাবেন এবং আপনার ব্যবসাও দ্রুত গতিতে এগোতে থাকবে।
কিন্তু তার জন্য আপনাকে আগে আপনার পেইজের ফলোয়ার বাড়াতে হবে। যখন আপনার পেইজে হাজার হাজার ফলোয়ার থাকবে তখনই আপনি আপনার সার্ভিস এবং প্রোডাক্ট লিস্টগুলোকে সুন্দর করে সাঁজাতে পারবেন। তাছাড়া আপনার পেইজে ফলোয়ারের সংখ্যা বেশি থাকলে এফিলিয়েট মার্কেটিং এর কাজও করতে পারবেন। যেটা আপনার জন্য বাড়তি আয় হিসেবে কাজ করবে।
(৩) ফেসবুক ইন-স্ট্রিম এডসঃ এখন ইউটিউবের মতো আপনিও চাইলে ফেসবুকে রেগুলার ভিডিও আপলোড করে টাকা ইনকাম করতে পারবেন। রিসেন্টলি ফেসবুকে একটি নতুন ফিচার চালু হয়েছে যেটার নাম হচ্ছে Reels। আপনি চাইলে এখানে প্রতিদিন নিজের তৈরি করা ভিডিও তে এড লাগিয়ে টাকা ইনকাম করতে পারবেন। এটাকেই বলে ফেসবুক ইন-স্ট্রিম এডস। এটাকে আপনি বাড়তি আয় কিংবা পার্ট টাইম বা ফুল টাইম ইনকামের রাস্তা হিসেবেও গ্রহন করতে পারেন।
আরো পড়ুনঃ ফ্রিল্যান্সিং এবং ক্রিয়েটিভিটি
Facebook ইন-স্ট্রীম বিজ্ঞাপনের জন্য আপনাকে যা করতে হবে তা হল-
- আপনার একটি ফেসবুক পেইজ থাকতে হবে,
- সেই পেইজে কম করে হলেও ১০,০০০ জন ফলোয়ার থাকতে হবে,
- যে ভিডিও আপলোড করবেন সেটা একদম ইউনিক কন্টেন্ট হতে হবে,
- আপনাকে এমন ভিডিও বানাতে হবে যেটা এডস লাগানোর জন্য উপযুক্ত এবং সেই সাথে ভিডিওটির সময়কাল ৩ মিনিটের উপরে হতে হবে,
- উক্ত ভিডিওটিকে ৬০ দিনের মধ্যে ১ মিনিট করে মিনিটে ৩০,০০০ ওয়াচ টাইম থাকতে হবে।
অতঃপর আপনি উক্ত ভিডিও থেকে টাকা ইনকাম করা শুরু করতে পারবেন।
(৪) ফেসবুক গ্রুপঃ ফেসবুক পেইজের মতো আপনি ফেসবুক গ্রুপেও অনলাইন বিজনেস চালু করতে পারবেন। আপনার গ্রুপে যত বেশি মেম্বার থাকবে ততো বেশি আপনার প্রোডাক্ট বিক্রি হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। আর ফেসবুক পেইজের তুলনায় ফেসবুক গ্রুপের মেম্বার বাড়ানো আরোও সহজ। আপনি পেইজের মতো এখানেও আপনার প্রোডাক্টের ছবি, মূল্য ও ডিটেইলস সহ পাবলিশ করে বিভিন্ন ক্রেতার নিকট তা বিক্রি করতে পারেন।
(৫) ফেসবুক অনলাইন এডসঃ অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যারা তাদের প্রোডাক্ট বিক্রির জন্য ফেসবুকে সেটার মার্কেটিং করে থাকে। যাতে তাদের প্রোডাক্ট টি বেশি সংখ্যক মানুষের নিকট পৌছায় এবং তারা কিনতে আগ্রহ প্রকাশ করে। এই যে মার্কেটিং এর ব্যবস্থা ফেসবুক করে দিয়েছে তার জন্যও কিন্তু টাকা দিতে হয়, যেটাকে ফেসবুক পেইড মার্কেটিং বলে।
আপনিও যদি ফেসবুকের মাধ্যমে ফেসবুক পেইড মার্কেটিং করে আপনার প্রোডাক্টের প্রচারণা চালাতে চান, তাহলে কম করে হলেও ১০০ টাকা দিয়ে আপনার প্রোডাক্টের জন্য মার্কেটিং শুরু করতে পারেন। আপনার প্রোডাক্ট বা স্টক নিজের ঘরে রেখেই ব্যবসা শুরু করতে পারবেন। যখন লোকজন আপনার প্রোডাক্ট কিনতে চাইবে তখন আপনি আপনার ঘর থেকেই উক্ত প্রোডাক্ট বা স্টক সমূহকে ডেলিভারি দিয়ে দিতে পারবেন।
তাই অবশ্যই ভালো মানের পন্যের উপর ফেসবুক অনলাইন এডস ব্যবহার করে আপনার প্রোডাক্টের বিক্রি ও প্রচার দ্রুত গতিতে বাড়াতে পারবেন।
আমাদের শেষ কথা
তো এই ছিলো আমাদের আজকের আর্টিকেল “ফেসবুকে অনলাইন ব্যবসা কিভাবে শুরু করবেন এবং ফেসবুকে অনলাইন ব্যবসা শুরু করার সেরা ৫ টি উপায়” সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা। আপনারা যারা নিজের ফেসবুক একাউন্ট থেকে ব্যবসা কিভাবে করবেন বলে বিভিন্ন কনফিউশনে ভুগছেন তারা একদম নিশ্চিন্তে উপরের গাইডলাইন গুলো মেনে নিজের একটি ব্যবসা শুরু করে দিতে পারেন।
বিভিন্ন বড় বড় কোম্পানি এবং প্রতিষ্ঠানগুলোও এভাবেই তাদের ব্যবসা শুরু করেছিলো। আজকে যেমন তারা সফলতার পর্যায়ে আছে ঠিক তেমনি আপনিও একদিন ঐ সফলতার পর্যায়ে যাবেন, যদি ধৈর্য, সাহস ও নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস থাকে। যদি আমাদের আর্টিকেলটি আপনার উপকারে এসে থাকে তাহলে অবশ্যই আপনার বন্ধু বান্ধবদের সাথে শেয়ার করবেন এবং নিজের ফেসবুক ওয়ালেও শেয়ার দিয়ে রাখতে পারেন, এতে অন্যরাও উপকৃত হবে। অতঃপর আপনার সফলতা কামনা করে আজকে এখানেই বিদায় নিচ্ছি, খোদা হাফেজ।